দেশের-খবর

দেশজুড়ে শীতের দাপট

হিমেল বাতাস ও ঘন কুয়াশায় শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় দেশজুড়ে চলছে শীতের দাপট। তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ঠান্ডা বাতাসে কাবু মানুষ। শৈত্যপ্রবাহের বিস্তৃতি আরও বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ সময় মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের গতকাল শুক্রবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাতের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে শৈত্যপ্রবাহ আরও বিস্তৃত হতে পারে। গতকাল সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। এটিই চলতি মৌসুমের সবচেয়ে কম সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে’র প্রতিবেদনে-

পঞ্চগড় জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯ টায় তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসে এ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই দিন সর্বোচ তাপমাত্রা ছিল ১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এতে ঠান্ডায় কাজ করতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। দুর্ভোগে রয়েছে ছিন্নমূল মানুষও।

স্থানীয়রা জানায়, গত বৃহস্পতিবার দিনে রোদ্র উঠলেও বাতাস থাকার কারনে কনকনে ঠান্ডা বিরাজ করছে। রাতে ঝড়ছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। ঠান্ডায় হাত পা বাঁকা হয়ে আসছে। হিমালয় থেকে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসায় এখানে শীতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশায় আচ্ছান্ন ছিল জনপদ, সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। রাতভর বৃষ্টিরমতো ঝড়েছে কুয়াশা। গতকাল শুক্রবার সকালে হেড লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখে গেছে। খড়খুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে অনেকে। তবে বেলা ১১ টার পরে সূর্য উঠলে স্বস্তি মিলে মানুষের মাঝে। ঠান্ডায় প্রতিনিয়ত নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ৮ ডিগ্রি থেকে ১০ ডিগ্রি পর্যন্ত মৃদু শৈত্য প্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রী পর্যন্ত মাঝারি, ৪ থেকে ৬ ডিগ্রী পর্যন্ত তীব্র, ৪ থেকে ০ ডিগ্রী পর্যন্ত অতি তীব্র। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যেবক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ্ জানান, জেলায় তীব্র শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছরের সবচেয়ে বেশি শীত বলেও জানান তিনি।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, মাঘের শীতে কাবু হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রাম। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মাঝারি শৈত্য প্রবাহ। কনকনে ঠান্ডা ও শীতের দাপটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশায় ঢেঁকে গেছে গোটা জনপদ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯ টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৬ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গত বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ছিল ৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা নিম্নগামী হওয়ায় শীত কষ্টে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষজন। ঘন-কুয়াশার সাথে হিমেল হাওয়া বাড়িয়ে দিচ্ছে শীতের তীব্রতা। তীব্র ঠান্ডায় মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছে। জেলার হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট,সর্দি কাশিসহ শীত জনিত রোগীর সংখ্যা। কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, জানুয়ারি মাস জুড়েই তাপমাত্রা এরকম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ মাসের ২৮ তারিখের পর তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।

দিনাজপুর অফিস জানায়, শীতে কাবু হয়ে পড়েছে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের মানুষ। দিনাজপুরে শীত যেন কমছেই না। গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। যেদিন সূর্যের দেখা মিলছে সেদিন শীতের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এককথায় প্রতিদিনই শীতের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। গতকাল শুক্রবার উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনাজপুরে রেকর্ড করা হয়েছে ৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল শুক্রবার সকাল ১১টার পর থেকেই সূর্যের মুখ দেখা যায়। খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছে। এবার শীত বস্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রেও যেন ভাটা পড়েছে। ফলে একদিকে কাজের অভাবে খাওয়ার জোগাড় এবং শীত বস্ত্রের অভাবে শীত মোকাবিলা করতে গিয়ে দিনান্তের মানুষেরা সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।

এবারে শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে কুয়াশা এবং হিমেল বাতাস বয়ে চলেছে। ঘন কুয়াশার কারনে বোরো বীজতলাসহ আলু ক্ষেত হুমকির মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক বীজতলার বীজ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। কুয়াশা কমলে আবার নতুন ভাবে বীজতলা তৈরী ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। এদিকে আগাম রোপণ করা আলু পেলেও নিয়মিতভাবে রোপণকৃত আলু ক্ষতির মুখে পড়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে দ্রুত শীতের প্রকোপ কমে গেলে বা কুয়াশা কমে গেলে বীজ তলা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

এদিকে প্রচন্ড শীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত জরুরি কাজ ছাড়া ঘর থেকে বাহির হচ্ছে না কেউ। অপরদিকে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত শীতের কারনে স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। ফলে খেটে খাওয়া মানুষেরা কাজ না পেয়ে অনাহার অর্ধাহারেই জীবন যাপন করছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে একজন দিনমজুর কাজ না পেয়ে এখন সামান্ন টাকার জন্য ঘণ্টা চুক্তিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ ইনকিলাবকে জানান, দিনাজপুরে ৬৬ হাজার কম্বল ১৩ উপজেলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে বেসরকারী সংস্থার পক্ষে কম্বল বা শীত বস্ত্র বিতরণের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে শীত যদি অব্যাহত থাকে অথবা অবনতি হয় তাহলে শীতজনিত কারনে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়ে গেছে। অপরদিকে শীতজনিত কারনে শিশুরা নিউমনিয়াসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতালে বেড না পেয়ে মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। বয়স্কদের অবস্থাও খারাপ। বাধ্যক্যজনিত কারনে মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে।

স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, প্রচন্ড ঘন কুয়াশা আন কনকনে হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মানুষসহ পশু-পাখি। অব্যাহত ঘন কুয়াশার সাথে প্রচন্ড হিমেল হাওয়া কাবু করে ফেলেছে শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষকে। গত ১৫ দিন ধরে অব্যাহতভাবে ঘন কুয়াশার কারনে সূর্যের দেখা না মিলছে না এ অঞ্চলে। ফলে কাঁথা-কম্বল হিম শীতল হয়ে আছে। এতে করে প্রচন্ড ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছে সব বয়সী মানুষ। প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে কোন কাজকর্মই ঠিকমত করতে পারছে না। কমবেশি সবখানেই শ্রমজীবি ও নিম্ন আয়ের মানুষ দিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত আগুণ জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। রাস্তা ঘাটেও বিভিন্্ন পেশার মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুনের তাপ নিয়ে হাত-পা শেঁকে নিচ্ছেন। ঘন কুয়াশার সাথে প্রচন্ড হিমেল হাওয়ার কারনে ঠান্ডার প্রকোপ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। এতে করে শিশু ও বৃদ্ধসহ মাঝ বয়সী লোকজন একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত প্রায় ১৫ দিন ধরে সূর্যের দেখা না পাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষ কাঁথা-কম্বল শুকাতে পারছে না। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের পাশাপাশি কাঁথা-কম্বল শুকানোর চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষ। বিকেল হতে না হতেই বৃষ্টির মত কুয়াশা ঝরতে শুরু করছে এবং তা পরদিন দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকছে। বিশেষ করে রাত ১২টার পর থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়ছে। দিনের বেলাতেও যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঠান্ডার কারনে মানুষ ক্ষেত-খামারে কৃষি কাজ করতে পারছেন না। জনজীবনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। পর্যাপ্ত গরম কাপড় না থাকায় ছিন্নমূল মানুষ পড়েছে মারাত্মক বিপাকে। ঠান্ডার কারণে শীত জনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে মারাত্মকভাবে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। অব্যাহত ঘন কুয়াশায় বোরো বিজতলা ও আলুক্ষেতের পাতায় পঁচন ধরেছে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় তিন শতাধিক শিশু। এভাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডেও শীত জনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুণ হারে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড এবং মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে বেড খালি না থাকায় রোগীদের ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালে চিকৎসকরা জানান, প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে রংপুর জেলাসহ আশে পাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন শত শত শিশু এবং বৃদ্ধ রোগী শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য আসছে। তাদের চিকিৎসা দিতে তারা বেশ হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে বেড খালি না থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বেড খালি না থাকার কারনে তারা গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যদের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন।