ম্যাক্সওয়েল বীরত্বে অস্ট্রেলিয়ার বিস্ময়কর জয়
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের অষ্টম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বীরত্বে বিস্ময়কর এক জয় পেল পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। গতকাল দিল্লির ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ১৯ বল হাতে রেখে ৩ উইকেটে আফগানদের হারিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে অজিরা। আগে ব্যাট করে ওপেনার ইব্রাহিম জাদরানের হার না মানা সেঞ্চুরিতে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ২৯১ রান তোলে আফগানিস্তান। জবাবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরিতে ৪৬.৫ ওভারে ৭ উইকেটে ২৯৩ রান করে বিস্ময়কর জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
এভাবেও ম্যাচ জেতা যায়? মাত্র ৯১ রানে নেই ৭ সেরা ব্যাটার। এতে আফগান বোলাররা দারুণভাবে উজ্জীবিত। নুর আহমদ, রশিদ খান, নাভিন-উল হকদের তোপের সামনে ঠিক যেন খড়-কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা। একই পথে হাঁটছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলও। ২২তম ওভারে লেগ স্পিনার নুর আহমদের করা ৫ম বলে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ফাইন লেগে। সরাসরি বল চলে যায় মুজিব-উর রহমানের হাতে। তালুতে নিয়েও বলটি ফেলে দেন মুজিব। হলো ক্যাচ মিস। তখন কি কারো ভাবনায় ছিল, ‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’। শেষ পর্যন্ত হলো তাই। ওই এক ক্যাচ মিসেই ম্যাচ মিস করে ফেললো আফগানিস্তান। নিশ্চিত জয়ের ম্যাচটি মুজিব ফেলে দিলেন হাত থেকে। ম্যাক্সওয়েল তখন ছিলেন ৩৩ রানে। অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ৭ উইকেটে ১১২। মুজিব ক্যাচটি ধরতে পারলে হয়তো এ ম্যাচের বয়স কিছুটা বাড়তো। তবে এমন বিস্ময়কর জয়ের দেখা পেত না অজিরা। কিন্তু তা আর হয়নি। ম্যাচের বয়স ঠিকঠাকই ছিল। ইতিহাস রচনা করলেন ম্যাক্সওয়েল। সেই ‘জীবন’ পেলেন, এরপর তাকে কাজে লাগালেন পুরোপুরিভাবে। দলকে অবিশ্বাস্য এক ইনিংস উপহার দিয়ে বিশ্বকে দেখালেন কিভাবে ম্যাচ জেতা সম্ভব। আফগান বোলিংকেই শুধু নয়, মুজিব-রশিদদের হৃদয়কেও ধুমড়ে-মুচড়ে দিলেন ম্যাক্সওয়েল। শেষ দিকে এসে ইনজুরিতে পড়লেন। দৌড়ে সিঙ্গেল কিংবা ডাবলস নিচ্ছিলেন না। শুধু চার আর ছয় মেরেই অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান ম্যাক্সওয়েল। উপহার দিলেন অবিশ্বাস্য এক জয়। ১২৮ বল মোকাবেলা করে ২১ বাউন্ডারি এবং ১০ ছক্কায় হার না মানা ২০১ রানের ইনিংস উপহার দেন ম্যাক্সওয়েল। অধিনায়ক প্যাট কামিন্সকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টম উইকেট জুটিতে ১৭০ বলে ২০২ রান তোলেন তিনি। ৬৮ বলে ১২ রান করে অপরাজিত থাকেন কামিন্স। ম্যাক্সওয়েলের এই লড়াইয়ে কামিন্সের অবদান কম নয়। তিনি যে জুটিটি উপহার দিলেন, তা বিরল হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে।
বিশ্বকাপে এটা নিয়ে মোট ৩টি ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছে। ক্রিকেটপ্রেমীরা যার দু’টির দেখা পেয়েছিলেন ২০১৫ আসরে। ওই বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৭ বলে ২১৫ রান করে রেকর্ডের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল। একই আসরে নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৬৩ বলে অপরাজিত ২৩৭ করে রেকর্ড গড়েছিলেন। আর কাল গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ১২৮ বলে ২০১ রানে অপরাজিত দেখালেন অনন্য এক কৃতিত্ব।
অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান ম্যাচটিকে কী ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বলা যাবে? বিতর্ক হতেই পারে। আফগান বিপক্ষে যে জায়গায় চলে গিয়েছিল অজিরা, সেখান থেকে একক প্রচেষ্টায় দলকে জেতানোর রেকর্ড আছে কি না সন্দেহ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যাটিং করে বীরোচিত এক ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে তুললেন ম্যাক্সওয়েল। ইনিংসের ২২তম ওভারেই আউট হতে পারতেন তিনি। কিন্তু অভিজ্ঞ আফগান ক্রিকেটার মুজিব-উর রহমানের ক্যাচ মিস ম্যাচের পুরো চিত্রই বদলে দেয়।
অথচ জয়ের জন্য ২৯২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে শুরুতেই চাপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। মাত্র ৪৯ রানের মধ্যেই সেরা চার ব্যাটারকে হারিয়ে বসে তারা। দ্বিতীয় ওভারেই অজি ওপেনিং জুটিতে ভাঙন ধরান আফগান পেসার নাভিন-উল হক। দ্বিতীয় ওভারেই ওপেনার ট্রাভিস হেডকে ফিরিয়ে দেন তিনি। ২ বলে কোনো রানই করতে পারেননি হেড। এরপর অবশ্য মিচেল মার্শ এবং ডেভিড ওয়ার্নার মিলে চেষ্টা করেন জুটি গড়তে। কিন্তু ৪৩ রানের মাথায় সেই নাভিন-উল হকের বলেই এলবিডব্লিউর শিকার হন মার্শ। ১১ বলে ২৪ রান করে আউট হন তিনি। ওয়ার্নার আর মার্নাস লাবুশেন মিলে জুটি গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ৯ম ওভারের প্রথম ও দ্বিতীয় বলে ওয়ার্নার এবং ইংলিশকে আউট করেন আজমতউল্লাহ ওমরজাই। মার্নাস লাবুশেন রানআউট হয়ে যান ২৮ বলে ১৪ রান করে। মার্কাস স্টয়নিজ রশিদ খানের বলে এলবিডব্লিউ হন ৭ বলে মাত্র ৬ রান করে। রশিদ খানের বলে মিচেল স্টার্ক ৭ বলে ৩ রান করে কট বিহাইন্ড হন। যদিও পরে রিপ্লেতে দেখা যায়, স্টার্কের ব্যাটেই বল লাগেনি। স্টার্ক রিভিউ নিলে হয়তো বেঁচে যেতেন। ওয়ার্নার, ট্রাভিস হেড, লাবুশেন, জস ইংলিশ, স্টয়নিজের মতো ব্যাটাররা যখন একে একে ফিরে যান আফগানদের সাঁড়াসি আক্রমণের মুখে, তখন একা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। একাই তিনি শাসন করে যাচ্ছেন আফগান বোলারদের। ৭৬ বলে ১০টি বাউন্ডারি এবং ৩টি ছক্কায় সেঞ্চুরি পূরণ করেন তিনি। এর আগে ৫১ বলে পূরণ করেন হাফসেঞ্চুরি। আর শেষ পর্যন্ত তো ডাবল সেঞ্চুরি করে দলকে নিয়ে যান সেমিফাইনালে। আফগানিস্তানের নাভিন-উল-হক, ওমরজাই এবং রশিদ খান যথাক্রমে ৪৭, ৫২ ও ৪৪ রানে পান ২টি করে উইকেট। অসাধারণ ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন ম্যাক্সওয়েল।
এর আগে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক হাশমতুল্লাহ শহিদী। ব্যাটিংয়ে নেমে দলকে ভালো শুরু এনে দিতে পারেননি দুই আফগান ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরান। কারণ ৮ ওভারেই বিচ্ছিন্ন হন তারা। দলীয় ৩৮ রানে পেসার জশ হ্যাজলউডের বলে স্টার্ককে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন গুরবাজ। ফেরার আগে ২৫ বল খেলে ২ চারের মারে ২১ রান করেন তিনি। এরপর অজি বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ইব্রাহিম জাদরান ও ইনফর্ম রহমত শাহ। এ দুইজন বেধরড় পিটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ইনিংসের ১৮তম ওভারে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করেন জাদরান। তার ৬২ বলের হাফসেঞ্চুরিতে ৬টি চারের মার ছিল। ২৫তম ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে ব্রেক থ্রু এনে দেন স্পিনার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ৪৪ বলে এক বাউন্ডারিতে ৩০ রান করা রহমতকে ফেরান ম্যাক্সওয়েল। ফেরার আগে দ্বিতীয় উইকেটে ১০০ বলে ৮৩ রানের জুটি গড়েন রহমত-ইব্রাহিম। চলতি বিশ^কাপে এ নিয়ে তৃতীয়বার দ্বিতীয় উইকেটে হাফসেঞ্চুরির জুটি গড়লেন তারা। রহমত আউট হওয়ার পর ক্রিজে ইব্রাহিমের সঙ্গী হন অধিনায়ক হাশমতুল্লাহ শহিদী। এই জুটি থেকেও হাফসেঞ্চুরি পায় আফগানিস্তান। কিন্তু ধীরলয়ে খেলেছেন দু’জনই। ৩৭.২ ওভারে দলীয় ১৭৩ রানে শহিদীকে হারায় আফগানরা। পেসার মিচেল স্টার্ক শহিদীকে বোল্ড করার আগে আফগান অধিনায়ক ৪৩ বলে ২ চারের মারে করেন ৪৩ রান। শাহিহী-ইব্রাহিম ৭৬ বলে ৫২ রান যোগ করেন দলীয় সংগ্রহে। পাঁচ নম্বরে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করেন আজমতুল্লাাহ ওমরজাই। স্টার্ক ও স্পিনার এডাম জাম্পাকে ২টি ছক্কাও মারেন তিনি। কিন্তু ভালো শুরুর পরও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি ওমরজাই। ৪২.৩ ওভারে দলীয় ২১০ রানে জাম্পার বলে ম্যাক্সওয়েলকে ক্যাচ দেয়ার আগে ২২ রান করেন ওমরজাই। তার ১৮ বলের ইনিংসে ১টি চার ও ২ ছক্কার মার ছিল।
ওমরজাই ফেরার পর ৪৪তম ওভারে নিজ ২৭ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পঞ্চম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ইব্রাহিম জাদরান। বিশ^কাপে প্রথম আফগান ব্যাটার হিসেবে শতক হাঁকাতে ১৩১ বল খেলেন তিনি। যেখানে ৭টি চারের মার ছিল। সেঞ্চুরির পর দলের রান চাকার গতি আরো বাড়িয়ে দেন ইব্রাহিম। ৪৫.৩ ওভারে দলীয় ২৩৩ রানে মোহাম্মদ নবী (১০ বলে এক ছক্কায় ১২) আউট হলে ইনিংসের শেষ দিকে ঝড়ো ইনিংস খেলেন রশিদ খান। শেষ পর্যন্ত ১৪৩ বলে ৮ চার ও ৩ ছক্কার মারে ১২৯ রানে অপরাজিত থাকেন ইব্রাহিম জাদরান। ২ চার ও ৩ ছক্কায় মাত্র ১৮ বলে ৩৫ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন রশিদ। বিশ^কাপ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে এটিই সর্বোচ্চ সংগ্রহ আফগানিস্তানের। অস্ট্রেলিয়ার হ্যাজেলউড ৩৯ রানে পান ২টি উইকেট।