দিনাজপুর শহরে পিঠা বানিয়ে অনেকের ভাগ্য বদল
জেলা শহরের নিমতলা মোড়ে শীতের এ মাঘ মাসে মিঠে পিঠা-পুলির ও মিষ্টিসহ রমরী পিঠার ঘ্রাণে মোহিত এলাকাটি। এখানে শীতের পিঠা বানিয়ে যেমন অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে,তেমনি শীতের পিঠা-পুলি খেয়ে অনেকে স্বাদ পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। দিনাজপুর শহরের নিমতলা মন্দির মোড়।শীত এলেই এখানে জমে উঠে পিঠা বিক্রি’র ধুম। ভাঁপা পিঠা,চিতই পিঠা,পাটিসাপটা, ও তেলের পিঠার ধোঁয়া আর সুগন্ধি মিষ্টি ঘ্রাণে সন্ধ্যার পর মোহিত হয়ে ওঠে এলাকাটি।ছড়িয়ে পড়ে পিঠা-পুলির ঘ্রাণ। এখানে কুয়াশা মুড়ানো শীতের হিমেল হাওয়ায় ধোঁয়া উঠা ভাঁপা-চিতই পিঠার স্বাদ না নিলে যেন তৃপ্তি মেটে না অনেকের।
সন্ধ্যা হলেই সারিবদ্ধ চুলার অল্প আঁচের ধোঁয়া উড়ছে। গরম গরম ভাঁপা, পাটিসাপটা,চিতই, তেলের পিঠা নামছে। ক্রেতারা এসে সারিবদ্ধ হয়ে পিঠা কিনছেন,খাইছেন-এ দৃশ্য চলে গভীর রাত পর্যন্ত। শহরের যান্ত্রিক জীবনে অনেকের সময় নেই,বাড়িতে পিঠা তৈরি করার।তাই নির্ভর এসব পিঠার দোকানেই। শীতের পিঠার স্বাদ নিতে তাই এইসব দোকানে ধুম পড়ে পিঠা বেচা-কেনার। এপিঠা বিক্রি করে অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে। হয়েছেন,স্বাবলম্বী-ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ। নারীরাও সংসারে অর্থ যোগান দিতে বেছে নিয়েছেন, এখানে পিঠা তৈরির কাজ।
তবে তীব্র শীতের প্রকোপে ক্রেতা কমেছে বলে জানালেন,পঞ্চাশোর্ধ বয়সের মরিয়ম বেগম। তার ভাই ময়নুল হক সহ তিনি এখানে পিঠা তৈরি ও বিক্রি করেন। মরিয়ম বলেন, ‘কমে গেইছে বেচা-বিক্রি। মানুষ আইসা কমে গেইছে।যে ঠান্ডা মানুষ ঘর থাকি বাইর হবার চায়না। মানুষ না আসিলে খাবি কে,বলেন ! আগের মতো আর বিক্রি নাই।’তবু বেচা কেনা চলছে। শুধু মরিয়ম নয়, দিনাজপুর শহরের এই নিমতলায় সালমা ও রাধা রানীসহ ৮ জন শীতের পিঠার দোকান করেন।
পিঠা বিক্রেতা ষাটোর্ধ বয়সের আব্দুল খালেক জানালেন,তিনি আগে ঠেলা গাড়ি চালাতেন।এই নিমতলা মোড়েই তারা ১৫/২০ জন ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে থাকতেন।এই স্থানটি এক সময় দিনাজপুরের একমাত্র ঠেলা গাড়ি স্ট্যান্ড ছিলো।যান্ত্রিক যুগে কালের বিবর্তনে সেই ঠেলা গাড়ি হারিয়ে গেছে। তাই তিনি বেকার হয়ে পড়েছিলেন। কোন কাজ না থাকায় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি আসে।পিঠা তৈরির দোকান দিয়ে বসেন তিনি। ৭/৮ আগে থেকে পিঠা বিক্রি করে আব্দুল মান্নানের ভাগ্য বদল হয়েছে। নিজে জমি কিনে বাড়ি দিয়েছেন। আরো কিছু আবাদি জমি কিনেছেন।মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।এখন ভালোই চলছে তার সংসার।
পিঠা বিক্রেতা মান্নান বলেন, ‘৭/৮ বছর যাবত এখানে পিঠা বিক্রি করি। সন্ধ্যার আগে আসি। গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। প্রতিদিন ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হয়।লাভ মোটামুটি ভালোই থাকে। এখানে আমার ছেলে সহ আরো ২/৩ জন কাজ করে। তবে আগের মতো আর বেচা-বিক্রি নাই।এখন অনেক পিঠার দোকান হইছে। আগে প্রথমে আমার ছিল পিঠার দোকান।দেখা-দেখি সবাই দোকান দিচ্ছেন। সরকারি রাস্তার জায়গা।দোকান দেয়াতো কাউকে মানা করা যাবেনা। যার পিঠা ভালো হবে,তারটাই মানুষ খাবে। আমারটা ভালো লাগলে,আমারটা খাবে। আমার অনেক ধরা-বান্ধা কাস্টমার আছে।যারা অর্ডার দিয়ে বেশি পিঠা নিয়া যায়।’
আবহমান গ্রাম বাংলায় শীতের পিঠা গ্রামীণ ঐতিহ্য। শীত মানেই পিঠা-পুলির ঘ্রাণ। কুয়াশা মুড়ানো শীতের হিমেল হাওয়ায় ধোঁয়া উঠা ভাঁপা-চিতই পিঠার স্বাদ না নিলে যেন তৃপ্তি মেটে না অনেকের। শীত মৌসুমে গ্রামীণ গৃহিত বধূরা রকমারি পিঠা তৈরি করেন। শীতের পিঠার মধ্যে ভাঁপা পিঠা,চিতই পিঠা,তেলের পিঠা পাটিসাপটা পিঠা অন্যতম। তবে শহরের যান্ত্রিক জীবনে ব্যস্ত মানুষজন। ঘরে তৈরি করে পিঠা খাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা।তাইতো অনেকে ছুঁটেন শহর ও শহরতলীর হাটবাজারে শীতের পিঠা খাওয়ার জন্য। বিশেষ করে ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা ও চিতই পিঠা অনেকের জনপ্রিয় খাবার।তাইতো নিমতলায় শীতের পিঠার ব্যবসা জমে উঠেছে। সন্ধ্যা হলেই দেখা যায়, চুলার অল্প আঁচের ধোঁয়া উড়ছে। গরম গরম ভাঁপা, চিতই নামছে। ক্রেতারা এসে সারিবদ্ধ হয়ে পিঠা কিনছেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। অল্প পুঁজি আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় পিঠা ব্যবসায় নেমেছেন অনেকেই।
শুধু শহরে নিমতলা মন্দির মোড় নয়,বাঞ্জারাম ব্রীজ, থানা মোড়, বটতলী, কাঞ্চন ব্রীজ মোড়, পুলহাট, ফুলবাড়ী বাস স্টান্ড,শেরশাহ ব্রীজ,মহারাজা মোড়, চাউলিয়াপট্রি মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট পিঠার দোকান সাজিয়ে বসছে নারী-পুরুষ বিক্রেতারা। অনেকেই এ শীতের মৌসুমে পিঠা বিক্রিকে বেছে নিয়েছেন মৌসুমী পেশা হিসেবে। বেচা-কেনাও বেশ ভালোই চলে। চলতি পথে থেমে বা অস্থায়ী দোকানের বেঞ্চে বসে বা দাঁড়িয়ে হালকা নাশতাটা সেরে নিচ্ছেন গরম গরম ভাঁপা পিঠা কিংবা চিতই পিঠা দিয়ে।
কেউবা চিতই পিঠার সাথে নিচ্ছেন ঝালযুক্ত সরিষা বাটা।ভাঁপা পিঠা খাচ্ছেন গুড় দিয়ে।গুড় আগে থেকেই ভাঁপা পিঠায় দেয়া থাকে।কেউ কেউ নারিকেলের গুড়াও দেয় ভাঁপা পিঠায়। প্রতিটি ভাঁপাপিঠা ও চিতই পিঠা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়।তবে,ঝাল অথবা সরিষা বাটা থাকছে ফ্রি। যুবক-যুবতি,বৃদ্ধ-আবাল-বণিরা সব বয়সের মানুষ আসেন দোকানে পিঠা খেতে। অনেকে বাসায় নিয়ে যান।
নিমতলা মোড়ে দাঁড়িয়ে পিঠা খেতে খেতে চিরিরবন্দর কৃষি কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমহোসেনের সাথে তিনি জানালেন, ‘আমরা প্রায়ই এখানে পিঠা খাই। পরিবারের জন্য বাসায় পিঠা নিয়ে যাই।আজ বউকেও সঙ্গে এনেছি। কর্মব্যস্ততার কারণে বাড়িতে চাল ভেঙে আটা করে পিঠা বানানোর সময় সুযোগ আর হয় না। ঝামেলা ছাড়াই স্বল্প দামে হাতের নাগালেই এখন পিঠা পাই। তাই এখন পথের ধারে পিঠাই আমাদের ভরসা।’
পিঠা কিনতে আসা আলেয়া রহমান বলেন, আমি প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর এই এখানে পিঠা খাই। শীতকালের খাবার মধ্যে পিঠা অন্যতম। আগে যদিও বাড়িতে এসব পিঠা বানানোর হিড়িক পড়তো এখন তা আর দেখা যায় না,।
সফিকুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, আমি আমার বন্ধুদেরকে নিয়ে পিঠা আড্ডায় মিলেছি। ভাবছি,কালও আসবো পিঠে খেতে।বেশ মজা লাগছে পিঠেগুলো।’
পিঠা বিক্রেতারা জামাল জানালেন, ‘ভাঁপা পিঠা তৈরির উপকরণ হচ্ছে চালের গুঁড়ো, নারকেল, খেজুরের গুঁড়। গোল আকারে পাতিলে কাপড় পেঁচিয়ে ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ির ফুটন্ত গরম পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভাপা পিঠা। অন্যদিকে, চালের গুড়ো পানিতে মিশিয়ে মাটির বাসনে তৈরি করা হচ্ছে চিতই পিঠা।’
কয়েকদিন ধরে দিনাজপুরে তীব্র শীত। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কনকনে শীত। এমন পরিবেশে শীতের পিঠা খেতে অনেকে পছন্ন করছেন।
সন্ধ্যার হিমেল হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পিঠা খেতে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন নিমতলা মোড়ে ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকান গুলোতে।এর মধ্যে ভাপা আর চিতই পিঠার কদর বেশি। এছাড়াও গড়ে ওঠা পিঠার দোকানে পাওয়া যাচ্ছে পুলি, ভাপা, তেলের পিঠা,পাটিসাপটাসহ হরেক রকম বাহারি পিঠা।
সুত্র- বাসস