অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা আল্লাহর রাগের কারণ
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে আমারই পোশাক এবং গর্ব-অহঙ্কার হচ্ছে আমারই চাদর। তাই যে ব্যক্তি এ দু’য়ের কোনোটি নিয়ে টানাটানি করবে, তাকে আমি কঠোর শাস্তি দেবো।’ (সহিহ মুসলিম)। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযিম। আমরা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এমনকি নিজেদের অজান্তে ভুল করেও আল্লাহর চাদর নিয়ে টানাটানি না করি। এ হাদিসে সুস্পষ্ট যে, তিল পরিমাণ অহঙ্কারী হওয়ারও অনুমতি বা অধিকার আল্লাহ কোনো বান্দাকে দেননি। অথচ আমরা কত প্রকারের কত পরিমাণ অহঙ্কারে যে জড়িয়ে যাই, তা ভেবেও দেখি না। একটু-আধটু সম্মান ও সম্পদের কারণে তো বটেই, এমনকি আল্লাহর ইবাদত, ইলম, আমল নিয়েও অহঙ্কার করি।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহ্যিক কিছু সুন্নতের ওপর আমল করেও আমরা কম-বেশি অহঙ্কারী হয়ে পড়ি। নিজেকে খুব আমলদার, পরহেজগার এবং সুন্নত পালনকারী ভেবে মনে মনে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ববোধ করি। সেই আমিত্বের ভাব ও আচরণ নিয়ে সমাজে চলি। অথচ এই দম্ভ ও অহঙ্কারের ভাবটুকুই আমাদের যতটুকু ইলম, আমল বা সুন্নতের অন্তত বাহ্যিক পাবন্দি ছিল, সেগুলোকেও বেকার ও বরবাদ করে দেয় প্রতিনিয়ত।
হযরত সালামা ইবনে আকওয়া (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মানুষ যখন নিজেকে নিয়েই কেবল ব্যস্ত থাকে, তখন একপর্যায়ে তাকে দাম্ভিকের কাতারে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়। তারপর দাম্ভিকের প্রাপ্ত সাজা-শাস্তি সেও পেয়ে থাকে।’ (সুনানে তিরমিজি)।
এখান থেকে একটি মহামূল্যবান পথনির্দেশ পাওয়া যায়। সেটি হলো, মানুষের একাকিত্ব যেমন আস্তে আস্তে মানুষকে হতাশা এবং মানসিক অসুস্থতার দিকে নিয়ে যায়; অনেকটা এ রকমভাবেই কোনো মানুষের একক স্বার্থচিন্তা, আত্মম্ভরিতা ও এককেন্দ্রিক উন্নতির প্রচেষ্টাও তাকে একসময় চরম দাম্ভিক ও অহঙ্কারী বানিয়ে ফেলে বা ফেলতে পারে।
কাজেই সর্বপ্রকার সাফল্য কামনা, হিতাকাক্সক্ষা ও কল্যাণচিন্তা আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সবার জন্য ও সবার সঙ্গে হওয়া উচিত। এতে মহব্বত বাড়বে এবং দম্ভ-অহঙ্কার হৃদয়ে স্থান করতে পারবে না। হাদিসের এই শিক্ষা ও সতর্কতা বুঝতে পারা এবং মেনে চলাই হবে প্রকৃত অর্থে সুন্নতের অনুসরণ করা।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি কিয়ামতের দিন আল্লাহ রহমতের নজরে তাকাবেন না। তাদের পবিত্রও (পাপমুক্ত) করবেন না। এমনকি তাদের সঙ্গে কোনো কথাই বলবেন না এবং তাদের কষ্টদায়ক শাস্তিতে নিমজ্জিত করবেন। এরা হচ্ছে- বৃদ্ধ যিনাকারী, মিথ্যুক শাসক ও দাম্ভিক ফকির।’ (সহিহ মুসলিম)
আস্তাগফিরুল্লাহ, এই হাদিসের উল্লিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকারের লোকদের আলোচনায় না গেলেও তৃতীয় প্রকারের আলোচনাটুকু না করলেই নয়। এখানে দাম্ভিক ফকির বলতে যদি আমরা প্রকৃত অর্থেই দরিদ্র ভিক্ষুকদের বুঝি, তা হলে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, দম্ভ ও অহঙ্কার কেবল ধন-দৌলত, ইজ্জত-শুহরতের সঙ্গেই শর্তবদ্ধ নয়। বরং এসব যার নেই, সেই প্রকারের বা সেই স্তরের মানুষও আত্মম্ভরিতা বা অজ্ঞতাবশত মিথ্যে অহঙ্কার অন্তরে, আচরণে ধারণ করতে পারে। মূলত অহঙ্কার একটি রোগ, আর রোগ তো ধনী-দরিদ্র যে কারো হতে পারে। এই অহঙ্কারকে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায’ অর্থাৎ ‘রোগের মা’। কারণ, অহঙ্কার থেকেই নানাবিধ পাপ-অবাধ্যতার জন্ম হয়ে থাকে।
আরেক অর্থে, এখানে কেবল ফকিরদের দম্ভকে দোষারোপ করার বা দাম্ভিক ফকিরের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা বলার কারণ বা ব্যাখ্যা এমনটিও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, সমস্ত মাখলুক, বিশেষ করে সমস্ত মানুষই আল্লাহর মোকাবেলায় চরম দরিদ্র, অসহায়, মুখাপেক্ষী। কাজেই মানুষমাত্রই আল্লাহর দৃষ্টিতে নগণ্য ফকির।
এ মানুষই যখন দম্ভ দেখায় তখন তা আল্লাহর চরম বিরক্তি ও রাগের কারণ হয়। এতটাই রাগ যে, আল্লাহর এসব লোকদের প্রতি তাকাতে বা কথা বলতেও রুচি হবে না। দুনিয়াতে আমরাও যার প্রতি অধিক বা চরম বিরক্ত হয়ে উঠি, তাকে বকাঝকা পর্যন্ত করতে মন চায় না। দেখলেও রাগ ওঠে। বস্তুত, সেদিন এমনই হবে আল্লাহর মেজাজ, যা দাম্ভিক-অহঙ্কারীর মর্মন্তুদ বিপদ ডেকে আনবে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।